রোজার খাদ্যাভ্যাসঃ অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা
লিখেছেন: ' shovoon' @ সোমবার, অগাষ্ট ১, ২০১১ (২:০০ অপরাহ্ণ)
স্বাস্থের উপর রোজার হিতকর প্রভাব
স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি দুটো দিক বিবেচনায়ই রোজার রয়েছে হিতকর প্রভাব। মন ও শরীর দুটোর কল্যাণের জন্যই রোজা অবশ্যকরণীয়। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরাও এ কথা এখন স্বীকার করছেন।সংযম পালন মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করে, রুচিকে পরিশীলিত করে, ভালো কাজ করার জন্য প্রণোদনা দেয়, সুস্থ মানস ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। কষ্ট সহ্য করার শক্তি, ধৈর্যশক্তি ও সংযম-এ গুণাবলি মানুষ অর্জন করে উপবাসচর্চায়।
দৈহিক-মানসিক নানা রোগ প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় রোজার ভূমিকা এখন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন। পাচকনালির রোগ, কোলাইটিস, যকৃতের রোগ, বদহজম, মেদস্থূলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি-এসব ব্যাধিতে উপবাসের ভূমিকা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানী মহলে ইতিবাচক আলোচনা যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি এর প্রয়োগও দেখা যাচ্ছে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে রোজা দেহের ক্ষয়ে যাওয়া কোষ ধ্বংসের কাজে সহায়তা করে, ক্ষুধা এ কাজকে পূর্ণতা দেয়। এরপর খাদ্য ও পুষ্টির মাধ্যমে নির্মিত হয় নতুন কোষকলা।এ জন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, তারুণ্য পুনরুদ্ধারের জন্য উপবাস হলো একটি কার্যকর উপায়।
হতে হবে খাদ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে যত্নশীল
রোজা নিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ভাবনার শেষ নেই। রোজায় সেহরি, ইফতার ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে মানুষের মনে এ সময়ে থাকে অনেক জিজ্ঞাসা। বর্তমান মাসে দিন বড় হওয়ায় রোজাও রাখতে হবে অনেকক্ষণ,প্রায় ১৫ ঘণ্টা অভুক্ত অবস্থায় থাকতে হবে,আর এই মাসে পানাহার থেকে বিরত থাকলেও আমরা সেহরির সময় কম আর ইফতারের সময় অনেকবেশী খাবার খায়,যার ফলে বেশ কিছু রোজা পার হলেই অনেকেই শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে কারন সাথে সাথে রোজা রাখা অবস্থায় কাজকর্মও করতে হয়।কিন্তু আমরা যদি আমাদের খাদ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে যত্নশীল হই তাহলে হয়তো অনেক সুন্দরভাবে আমরা সিয়াম পালন করতে পারবো।
মানসিক এবং ধর্মীয় আত্মবিশ্বাস
রমজানের এই সময়টিতে স্বভাবতই আমাদের দেহঘড়ির খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। এছাড়া আবহাওয়া ও শারিরীক অবস্থার কারণে রোজা রাখতে গিয়ে অনেকে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হন। যদিও মানসিকভাবে শক্ত থাকলে এবং মনে ধর্মীয় আত্মবিশ্বাস থাকলে এইসব সমস্যার অনেকটাই সমাধান করা যায়। তবে রোজার এই সময়টিতে কারো খাদ্যাভ্যাস যেন তার জন্য সমস্যার কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য খানিকটা সতর্কতারও প্রয়োজন রয়েছে।
খাবার ও খরচে সংযম
রমজান হচ্ছে সংযমের মাস। রমজানে আমাদের খাবার কম হওয়া উচিত। খরচ কম হওয়া উচিত। সেখানে রমজানে আমাদের প্রত্যেকের খাবারের খরচ দ্বিগুন বেড়ে যায়। এই একমাস আমরা যেন খাবারের প্রতিযোগিতায় নেমে যাই। রমজানে আমরা এত বেশি খাই যে জিনিস পত্রের দামও বেড়ে যায়। এটা হচ্ছে আমাদের একটা পরিহাস। আমাদের একটা ভুল ধারণা হলো রমজান মাসে যত খাওয়া হবে তার কোনো হিসেব নেয়া হবে না। এগুলো ইসলাম সম্মত নয়ই এবং এগুলো হচ্ছে এক ধরনের কুসংস্কার এবং খারাপ অভ্যাস।
সঠিকভাবে খাদ্য নির্বাচন
রোজা পালন করতে গিয়ে অনেকে শঙ্কিত বোধ করেন, যদি তাঁদের কোনো অসুস্থতা থাকে। তবে যদি রোগ বুঝে খাওয়া হয়, তাহলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। আবার যাঁদের কোনো অসুস্থতা নেই, তাঁরাও যদি সঠিকভাবে খাদ্য নির্বাচন করে খান তাহলেও তাঁরা নির্বিঘ্নে এক মাস রোজা রাখতে পারেন। আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে রমজানে যে খাদ্যাভ্যাস লক্ষ্য করা যায়, তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ সময়ে খাবারের প্রধান পর্যায় দুটি-সেহরি ও ইফতার। আমাদের দেশে সেহরি ও ইফতারের অধিকাংশ খাবারই হচ্ছে চর্বি সমৃদ্ধ এবং তেলে ভাজা। সেহরি ও ইফতারের খাবার নির্বাচনে রোজাদারের বয়স ও শারীরিক অবস্থাকে বিবেচনায় রাখা হয় না। কিন্তু এসব দিকে নজর দিতে হবে।
খেতে হবে অল্প পরিমানে
সারা দিন না খেয়ে থাকার ফলে অনেকে মনে করেন ইফতারে বেশি করে না খেলে শরীর টিকবে না।আসলে শরীর ঠিক থাকবে পরিমিত ও সুষম খাবারের মাধ্যমেই। বেশি খাওয়ার মাধ্যমে নয়।প্রয়োজনের তুলনায় যত বেশি খাবার খাওয়া হবে, ততই এর কুফল ভোগ করতে হবে। কারণ, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ইফতারি ও সেহ্রির খাবার খেলে ক্ষুধার ভাব বেশি লাগে। যদি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া হয়, তাহলে ক্ষুধাটা অত তীব্র হয় না। ইফতার ও সেহ্রিতে খুব বেশি পরিমাণে খেলে দিনের বেলায় ক্ষুধার তীব্রতা বাড়ে। এ ছাড়া অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে বমি, পেট ব্যথা, গ্যাস্ট্রাইটিস, পেট ফাঁপা, মাথা ধরা প্রভৃতি।সারা দিন রোজা রাখার বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার বেশি খেলে যেমন শরীরের ওজন বেড়ে যায়, তেমনি হজমেও গোলমাল হতে পারে।
আহার হবে পরিমিত, সুষম,সহজপাচ্য ও সাধারণ
রোজার মাসে আহার, স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস থেকে খুব বেশি ভিন্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আহার হবে সহজপাচ্য ও সাধারণ। এ খাদ্য খেয়ে যেন স্বাভাবিক ওজন শরীরে বজায় থাকে, কমা ও বাড়া যেন ঘটে না। কেউ স্থূল হলে স্বাভাবিক ওজনে ফিরে আসার জন্য এ মাসের সংযম পালন সহায়ক।আমাদের শরীরের জন্য কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার, অর্থাৎ ভাত, রুটি; প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাবার মাছ, মাংস; ডালজাতীয় খাবার এবং ফ্যাট বা চর্বিজাতীয় খাবার, অর্থাৎ মাখন, ঘি ইত্যাদি দরকার। পরিমিত সুষম খাবার খেলে শরীর সুস্থ থাকে এবং দিনের কাজগুলো সঠিকভাবে করা যায়।
বর্জন করতে হবে অতিরিক্ত তেল, মসলাযুক্ত খাবার, চর্বিজাতীয় খাবার
রোজার সময় আমাদের দেহের বিপাকক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। স্বাভাবিক হজম-প্রক্রিয়ার জন্য অতিরিক্ত তেল, মসলাযুক্ত খাবার, চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া ঠিক নয়। বিরিয়ানি, তেহারি, নেহারি, খাসির রোস্ট-জাতীয় খাবার সেহরি বা রাতে না খাওয়াই ভালো।কারন এসব খাবার স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করতে পারে।
খেতে হবে এমন সব খাদ্য যা ধীরে পরিপাক হয়
দীর্ঘ সময় উপবাসের প্রেক্ষাপটে খেতে হবে এমন সব খাদ্য, যা ধীরে পরিপাক হয়। সেই সঙ্গে থাকবে আঁশসমৃদ্ধ খাবার। দ্রুত হজম হয় এমন খাদ্য কম খেলে ভালো।ধীরে পরিপাক হয় এমন খাদ্য থাকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত, আবার দ্রুত পরিপাচ্য খাবার থাকে মাত্র তিন-চার ঘণ্টা।ধীরে পরিপাক হয় এমন খাদ্যের মধ্যে রয়েছে শস্য ও বীজ। যেমন বার্লি, গম, জইচূর্ণ, শিম, ডাল, আটা, ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল। এগুলোকে বলে জটিল শ্বেতসার। দ্রুত দহন হয় এমন খাবারের মধ্যে রয়েছে চিনি, ময়দা (পরিশোধিত শর্করা)।
খাদ্য তালিকায় থাকতে হবে আঁশসমৃদ্ধ খাদ্য
আঁশসমৃদ্ধ খাদ্য হচ্ছে গম, আটা, শস্যদানা ও বীজ, শাকসবজি, মটরশুঁটি, শিম, বরবটি, ঢ্যাঁড়স, পুঁইশাক, মেথিশাক, খোসাসহ ফল, শুকনো ফল, ডুমুর, খেজুর, বাদাম।খাদ্য হবে সুষম এবং প্রতিটি গ্রুপ থেকে খাবার আহরণ করতে হবে। যেমন ফল, সবজি, গোশত, কচি মোরগ, মাছ, রুটি, শস্য, দুধ ও দুধজাত খাবার। তেলে ভাজা খাবার স্বাস্থ্যকর নয়। এতে বদহজম হয়, বুক জ্বলে ও ওজন বাড়ে।
যেসব খাবার বর্জন করতে হবে
যেসব খাবার বাদ দিতে হবে সেগুলো হলো তেলে ভাজা খাবার ও চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি ও মিষ্টি খাবার। অতিভোজন বিশেষ করে সেহরির সময় বেশি চা পান করাও ঠিক নয়। চা পান করলে বেশি বেশি প্রস্রাব হয়। অনেক খনিজ তাই বেরিয়ে যায়, যা দিনের সময় প্রয়োজন। ধূমপান, মদপান কখনোই নয়।
পান করতে হবে প্রচুর পরিমানে পানি
রোজার সময় পানির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেহরি, ইফতার ও রাতের খাবারের পর দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করা উচিত। পানি আমাদের শরীরের বিপাকক্রিয়া ও কিডনির যথাযথ কাজের জন্য প্রয়োজন। পানি কম খেলে দিনে মুখ ও জিহ্বা শুকনো থাকে, পানিস্বল্পতার জন্য শরীরে ক্লান্তি আসে।
সেহরি ও ইফতারে পেট পুরো না ভরে বেশি করে পানি পানি পান উচিত। পানি আপনার শরীরের কোষগুলোকে সজীব রাখবে।যথেষ্ট পানি ও ফলের রস, ইফতারের সময় থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, যাতে যথাসময়ে শরীরে তরল ভারসাম্য বজায় থাকে।এ সময় অনেকের মধ্যে পানিশূন্যতা দেখা যায়। এ জন্য ইফতারিতে ভেজা চিঁড়া, দই, চিঁড়ার পোলাও, দুধ-সেমাই, পায়েস, নরম খিচুড়ি খেলে ভালো হয়।
পরিশেষে আমার বিশ্বাস আপনারা সবাই আপনাদের খাদ্যাভ্যাসটা শৃংখলার মধ্যে রাখতে পারবেন এবং সুস্থ্য থাকবেন।
গুরুত্ব পূর্ণ এই লেখাটির জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাযাকাল্লাহ।