ডারউইনবাদী নৈতিকতা!
লিখেছেন: ' সরোয়ার' @ বুধবার, অক্টোবর ২৭, ২০১০ (২:৫৭ অপরাহ্ণ)
পৃথিবীর সব সমাজেই ধর্ষণ একটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও প্রচণ্ড শাস্তিমূলক অপরাধ। কিন্তু বিবর্তনবাদীয় নৈতিকতা অনুযায়ী ধর্ষণের মতো অপরাধকে পজিটিভ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়! এক জরিপে দেখা যায় ধর্ষণের মাধ্যমে প্রায় ৩০% মহিলা গর্ভবতী হয়। অন্যদিকে সহমত অনুযায়ী একবার মিলিত (consensual sex) হলে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা ২-৪%। এই পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে বায়োলজি প্রফেসর রান্ডি থর্নহীল (Randy Thornhill) ও নৃ-বিজ্ঞানী ক্রেইগ পালমার (Craig Palmer) তাদের লিখিত “Natural History of Rape” বই-এ ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদ অনুযায়ী প্রমাণ করেন ধর্ষণ হচ্ছে প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল বা এডাপ্টিভ (Adaptive), কেননা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কোন প্রজাতিকে টিকে থাকার জন্য ধর্ষণ সহায়ক!
পুরুষেরা নাকি ধর্ষণের মাধ্যমে তাদের জীন ছড়িয়ে দেয় যা তার বংশধারা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে! প্রাণীজগতেও ধর্ষণ বিদ্যমান। তার মানে বিবর্তনবাদীয় ধারায় এই স্বভাব মানুষও অর্জন করেছে! পরবর্তীতে তাদের এই ধারণাকে অপ-বিজ্ঞান বলে আখ্যা দেওয়া হয় (বিস্তারিত)। কিন্তু বিবর্তনবাদী সাইকোলজিষ্টরা মনে করেন তাদের এই সব “ধ্রব” বা “সূর্য-উঠার” মতো সত্য পর্যবেক্ষণগুলো পলিটিক্সের শিকার। বিবর্তনবাদীয় সাইকোলজি অনুযায়ী মানবের সব স্বভাবই (মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা ইত্যাদি) এডাপ্টিভ হিসেবে গণ্য করা হয়, কেননা এগুলো প্রজাতির বংশধারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বজায় রাখতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
ধর্ষণে সাধারণত নারীরা শিকার (ভিকটিম) হয়; আর পুরুষদের এটা হচ্ছে জীন ছড়ানোর মাধ্যম। অন্যদিকে, এর বিপরীতে অনেক স্বভাব পশু বা প্রাণীকুলে দেখা যায়। যেমন সেক্সুয়াল ক্যানাবলিজমে (Sexual cannibalism) পুরষেরা হচ্ছে ভিকটিম। এটা সাধারণত পোকা (Insect) জাতীয় প্রাণীতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে রতিক্রিয়ার সময় বা শেষে স্ত্রী পোকা তার মিলনের পার্টনারকে (পুরুষ) খেয়ে ফেলে! এ ঘটনাকেও বিবর্তনবাদ তত্ত্বের ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়! বিবর্তনবাদীয় ভাষায় এটাও নাকি প্রজাতির টিকে থাকার জন্য সহায়ক (অন্য ভাষায়, সারভাইভাল বেনিফিট দেয়), কেননা এতে করে স্ত্রী পোকার খাদ্য সংস্থান হয়! কিন্তু সাধারণ যুক্তি অনুযায়ী এতে করে বরং প্রজাতি বিলুপ্তির সম্ভাবনা থেকে যায়। বিবর্তনবাদীয় সাইকোলজি প্রসংগে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য ফিলিপ স্কেল (Philip Skell) বলেন বিবর্তনবাদীয় সাইকোলজির ভিত্তি বেশ দুর্বল। তিনি মন্তব্য করেন এভাবেঃ
Darwinian explanations for such things are often too supple: Natural selection makes humans self-centered and aggressive — except when it makes them altruistic and peaceable. Or natural selection produces virile men who eagerly spread their seed — except when it prefers men who are faithful protectors and providers. When an explanation is so supple that it can explain any behavior, it is difficult to test it experimentally, much less use it as a catalyst for scientific discovery.
সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল পরিচিত প্রফেসর মার্ক হসের (Marc Hauser) বিবর্তনবাদীয় সাইকোলজির ভিত্তিকে বেশ নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। তার প্রাইমেটের স্বভাব (বিহেভিরিয়াল) স্টাডির উপর ভিত্তি করে মূলত দাঁড়িয়ে আছে পুরো ইভ্যলুশনারী সাইকোলজি (Evolutionary Psychology) রিসার্চ ক্ষেত্র। নিজের লিখিত Moral Minds: How Nature Designed Our Universal Sense of Right and Wrong নামক বই-এ নৈতিকতা বা মোরালিটিকে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন (বুক রিভিউ দেখুন)। তার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের রিসার্চের তথ্য ব্যবহার করেছেন। তিনি বানরের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বেশ বড় বড় দাবী (ক্লেইম) করেছেন। উনার স্টাডিকে কেন্দ্র করে অনেক রিসার্চ হচ্ছে। কিন্তু বিবর্তনবাদীয় সাইকোলজি অনুযায়ী নৈতিকতা বা মোরালিটিও বিবর্তনবাদের অংশ। বর্তমানে তিনি Evilicious: explaining our evolved taste for being bad নামে বই লিখছেন।
অত্যন্ত দুঃখজনক খবর হচ্ছে যে মার্ক হসের তার গবেষণার ডাটা তৈরীতে কমপক্ষে আটবার অসাধুতা বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন তা প্রমাণিত হয়েছে। ল্যাবের ছাত্র ও টেকনিশিয়ানের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে। অসাধুতার জন্য সম্পতি তার বিখ্যাত পেপার জার্নাল কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত প্রাইমেটোলজিস্ট Frans de Waal বলেনঃ
[I]t leaves open whether we in the field of animal behavior should just worry about those three articles or about many more, and then there are also publications related to language and morality that include data that are now in question. From my reading of the dean’s letter, it seems that all data produced by this lab over the years are potentially in question.
বিবর্তনবাদীয় সাইকোলজি অনুযায়ী মন্দ স্বভাব (Bad behavior)-কে পজিটিভ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে যদি সারভাইভাল বেনিফিট-ই থাকে তবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কেন খারাপ গুণ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে? নৈতিকতার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনিই প্রতারণার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন! বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হলে বিবর্তনবাদীয় নৈতিকতা অনুযায়ী তাকে দোষ দেওয়া যায় না, কেননা এতে সারভাইভাল বেনিফিট বিদ্যমান।
ধর্ম ও নৈতিকতা সমাজে ওত-প্রোতভাবে জড়িত। সমাজে প্রচলিত নৈতিকতা ধর্মীয় ভাবধারা থেকে এসেছে। এই নৈতিকতা অনুযায়ী ভাল-মন্দের সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে এবং এর ভিত্তি হচ্ছে বিবেক (conscience), যার মাধ্যমে মানুষ ভাল-মন্দ বিচার করতে পারে। অন্যদিকে বিবর্তনবাদীয় নৈতিকতার কোন মাপ-কাঠি নেই। এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। বিবেক বলে কোন শব্দ বিবর্তনবাদীয় অভিধানে স্থান নেই! বিবর্তনবাদীরা “বিবেক” নামক ইস্যুকে গ্রহন করলে বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রচলিত বিতর্ক অনেক আগেই অবসান হতো। পরিবেশের টিকে থাকার জন্য যা দরকার সেটাই হচ্ছে বিবর্তনবাদীয় নৈতিকতার ভিত্তি। যেমন ধর্ষণ, প্রতারণা, মিথ্যা বলাও এই নৈতিকতার অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। চিন্তা করুন, আমরা চিকেন বা মাছ খাওয়ার সময় কি নিজেরকে দোষী মনে করি? উত্তর হচ্ছে মোটেও না। কারণ আমরা বেঁচে থাকার জন্য খেয়ে থাকি। ধর্মীয় ভাবধারা অনুযায়ী এটা স্রষ্টার নির্দেশ। অন্যদিকে বিবর্তনবাদীয় নৈতিকতার অনুযাযী বেঁচে থাকার জন্য ধর্ষণ-প্রতারণাকে জাস্টিফাই করে। এ প্রসংগে সদালাপের এক লেখিকার লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করতে চাই। তিনি বিবর্তনবাদ ধর্মের বর্তমান গুরু ডকিন্সের ‘The Selfish Gene’ বইয়ের বুক রিভিউতে লিখেন-
…biologically it is our fundamental nature to be selfish, so we should try to teach generosity and altruism because a human society based on gene’s law of ruthless selfishness would be a very nasty society in which to live.
ধর্ম (ইসলাম)-বিদ্বেষী মুক্তমনারা আমাদের সমাজে বিবর্তনবাদীয় নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছেন। এদের ধর্মগুরু ডঃ অভিজিৎ রায়ের মতে ‘নৈতিকতাকে স্বতন্ত্র কোন প্রতিষ্ঠান হিসেবে না দেখে বিবর্তনের আলোকেই দেখা উচিৎ’। তারা বিবর্তনবাদীয় নৈতিকতার আলোকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করেন (তার একটি নমুনা দেখুন)। উনাদের ভাবধারা অনুযায়ী সমকামিতায় দৃঢ় বিশ্বাসী না হলে বিবর্তনবাদী হওয়া যাবে না। আর বিবর্তনে কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে সে অটোমেটিক্যালি নাস্তিক হয়ে যায়। সম্প্রতি ডঃ জাফর ইকবালের ধর্ম-বিশ্বাস নিয়ে টানা-হেঁচড়া হয়েছে। তাদের বিবেচনায় ডঃ জাফর ইকবাল বিবর্তনবাদের কট্রর সমর্থক হয়েও নাস্তিক হতে পারেননি, কেননা তিনি সমকামিতাকে ঘৃণা করেন। সমকামিতাকে বাদ দিয়ে বিবর্তনবাদী নাস্তিকও হওয়া যায় না! অথচ এরাই নিজেদেরকে বিজ্ঞানমনষ্ক ও অত্যন্ত প্রগতিশীল বলে দাবী করেন! এসবই যদি প্রগতিশীলতার তথাকথিত “বৈজ্ঞানিক” ভিত্তি হয় তাহলে এদের কল্পিত সমাজ ব্যবস্থা কেমন হবে তা পাঠকের বিবেচনায় ছেড়ে দিলাম।
নোটঃ লেখাটি সদালাপে প্রথমে প্রকাশিত হয়। সেখানের তথ্য-পুর্ন আলোচনা অংশ নিতে পারেন।