যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ হযরত সাইয়্যেদ আহমাদ কবীর রেফায়ী (রহঃ) এর জীবনী – পর্ব ০১
লিখেছেন: ' Tarek000' @ মঙ্গলবার, মে ২২, ২০১২ (৪:০৯ অপরাহ্ণ)
১. বংশ পরিচয়
প্রসিদ্ধ আছে যে, ইসলামে বংশীয় মর্যাদার কোন গুরুত্ব নেই, বরং সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে শুধু তাকওয়া ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য।
পবিত্র কালামে পাকে বলা হয়েছে-
ان اكرمكم عندالله اتقاكم
“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহার নিকট অধিক মর্যাদার অধিকারী যে অধিক মুত্তাকী।
( সূরা হুজুরাত : ১৩/২৬ )
হযরত বিলাল হাবশী (রা), হযরত সুহাইব রূমী প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম (রা) একারণেই মুসলিম মনীষীদের নিকট অতীব সম্মানিত ও মর্যাদাশীল।
কিন্তু এর অর্থ মোটেই এই নয় যে, ইসলামে বংশীয় মর্যাদার কোনও গুরুত্ব নেই। কারণ
(ক) আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে: মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বংশীয় মর্যাদা ইত্যাদি যথেষ্ট নয়; সাফল্যের জন্যও যথেষ্ট নয়, বরং বংশ ইত্যাদির সাথে ঈমান, আমল ও তাকওয়ার খুবই প্রয়োজন।
(খ) যদি কারো বংশীয় মর্যাদা না থাকে আর তার মধ্যে তাকওয়া বিদ্যমান থাকে তবে তার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা ন্যায়সঙ্গত হবে না, তাকে ছোট মনে করার অনুমতি নেই।
বস্তুত: তাকওয়ার সাথে বংশীয় মর্যাদার গুরুত্ব আছে বলেই বিবাহ-শাদী ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্নে ইসলামে এর প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
الائمة من قريش
“ইমাম (খলীফা) কুরাইশ থেকে নির্বাচিত হবে।”
( আহকামুস সুলতানিয়াহ : ৬ )
অনুরূপ হযরত আবু সুফিয়ান রা. এর বক্তব্যের প্রতি উত্তরে রোম সম্রাট মন্তব্য করে বলেছিলেন,
سألتك عن نسبه فذكرت انه فيكم ذونسب وكذلك الرسل تبعث في نسب قومها
আমি তোমাকে তাঁর (হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বংশ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি, তুমি তার উত্তরে বলেছ যে, তিনি তোমাদের মধ্যে উচ্চ বংশজাত। এভাবেই নবীদেরকে তাদের জাতির উচ্চ বংশে পাঠান হয়।
( বুখারী শরীফ : ১/৪ )
উল্লেখিত হাদীসসমূহ আমাদের বক্তব্যের পক্ষে অকাট্য যুক্তি।
বংশ মর্যাদার প্রশ্নে হযরত সাইয়্যেদ আহমাদ কবীর রেফায়ী (রহঃ) কে আল্লাহপাক অত্যন্ত সম্মানিত করেছেন। তাঁর সিলসিলায়ে নসবের দ্বারা তা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।
২. নসবনামা
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হচ্ছেন আখেরী পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর হযরত রেফায়ী (রহঃ) হচ্ছেন তারই বংশের একজন মহামানব। আওলাদে রাসূল হযরত রেফায়ী কবীর (রহঃ) এর নসবনামা বড়ই বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ।
পিতার দিক দিয়ে তাঁর নসব জান্নাতের সরদার শহীদে কারবালা হযরত হুসাইন (রাঃ) এর সাথে মিলিত হয়।
আর মাতার দিক দিয়ে মদীনা শরীফে হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রথম মেযবান প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) এর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়।
( আকতাবুল আরবাআ : ৩০/৩১ )
অপর এক সিলসিলায় হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) – এর সঙ্গেও রেফায়ী (রহঃ) – এর নসব মিলিত হয়। সুতরাং তিনি একই সঙ্গে আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হুসাইনী, আনসারী ও সিদ্দিকী বংশের মহান মর্যাদার অধিকারী।
৩. জন্ম ও জন্মস্থান
হযরত রেফায়ী কবীর (রহঃ) এগারোশত আঠারো খৃষ্টাব্দে মোতাবেক পাচশত বারো হিজরী সনে ‘মকামে হাসানে’ জন্মগ্রহণ করেন।
( বুনইয়ানুল মুশাইয়াদ : ৫ )
এই গ্রামটি ইরাকের অন্তর্গত ওয়াসেত ও মিসরের মধ্যবর্তী স্থানে উম্মে আবীদার নিকটে ‘বাতায়েহ’ নামক এলাকায় অবস্থিত।
( রাওয়ারিকুল হাকায়েক : ২১৯; হেকমতে রেফায়ী : ১২ )
যুগটি ছিল খেলাফতে আব্বাসিয়ার খলীফা মুস্তারশিদ বিল্লাহর যুগ।
( মাজালিসে রেফাইয়্যাহ : ২১ )
ওয়াসেত এলাকাটিকে মালেক বিন মারওয়ানের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছাকাফী তিরাশি হিজরীতে আবাদ করেন এবং খেলাফতে আব্বাসিয়ার যুগে সর্বদিক দিয়ে তা সমৃদ্ধি লাভ করে। ফলে বাদশাহ মামুনুর রশীদ এবং অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ রাজকীয় প্রসাদকে রকমারী সরঞ্জামে সুন্দর ও সজ্জিত করে তোলেন। পাশাপাশি বিশ্বের সেরা আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট ওলী-দরবেশদেরও সমাবেশ ছিল ওয়াসেতে অনেক বেশি। ইলমে মারিফাতের কেন্দ্রভূমি, আধ্যাত্মিক জগতের মাশায়েখ পীর আওলিয়াগণের পবিত্র স্থান ওয়াসেতের এই এলাকাতেই হযরত রেফায়ী (রহঃ) জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এখানেই তাঁর জীবন সাধনার নিদর্শন খানকাহে রেফাইয়্যাহ অদ্যাবধি বিদ্যমান রয়েছে। আজও সেখানে অসংখ্য আল্লাহ প্রেমিকগণ যিয়ারতের জন্য উপস্থিত হন।
৪. জন্মের আগাম সুসংবাদ
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো জন্ম গ্রহণ করেননি, কিন্তু নবীগণ তাঁর জন্মের সুসংবাদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামও রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের সুসংবাদ শুনিয়েছেন তাঁর কওমকে।
( সূরা ছাফ : ৬/২৮ )
তাওরা, যাবূর এবং ইঞ্জিলেও সুসংবাদ বিদ্যমান রয়েছে। মাতা আমেনাও সুসংবাদ পেয়ে মুহাম্মাদ নাম রাখতে আদিষ্ট হয়েছিলেন।
( খুতবাতে আহমাদিয়া : ৪৩১ )
অগণিত আওলিয়া কেরামদের ক্ষেত্রেও আমরা সুসংবাদের এই খোদায়ী বিধান দেখতে পাই।
হযরত রেফায়ী কবীরও তাদের মধ্যে এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব যাঁর জন্মের পূর্বেই জন্মের সুসংবাদ প্রকাশ পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ওলী শেখ বাহাউদ্দীন হুসাইনী (মৃত্যু ১২৮৭ হি.) বলেন-
ক. সুফীদের সরদার, আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট শেখ আবুল ওয়াফা (রহঃ) যখন মাকামে উম্মে আবীদায় সফর করছিলেন তখনো হযরত রেফায়ী (রহঃ) – এর জন্ম হয়নি। তিনি সেখানে পৌছে বলেছিলেন, উম্মে আবীদা অচিরেই ওলীদের সমাবেশ স্থলে পরিণত হবে। আর অদূর ভবিষ্যতে এই পবিত্র নগরীতে আহমাদ রেফায়ী নামের এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করবে, সমগ্র পৃথিবীর আধ্যাত্মিক সম্রাটগণ তার সম্মুখে নতশীর হবে।
( বাওয়ারিকুল হাকায়েক : ২২৪ )
খ. শেখ আবু মুহাম্মাদ শান্বাকী এবং বাতায়েহীও এ ধরনের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।
গ. হযরত রেফায়ী কবীর (রহঃ) -এর শায়েখ ও মামা যুগশ্রেষ্ঠ ওলী আরেফে রাব্বানী শেখ মনসুর বাতায়েহী (রহঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সম্বোধন করে নির্দেশ করছেন :
হে মনসুর! “আজ থেকে চল্লিশ দিন পর তোমার বোনের এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তার নাম আহমাদ রাখবে। যেমন আমি সকল নবীগণের সরদার এবং নেতা, তেমনি আহমাদ সকল ওলী গাউসদের সরদার এবং নেতা হবে। সে যখন একটু বয়স্ক ও হুশিয়ার হয়ে উঠবে তখনই তাকে শেখ ওয়াসেতীর নিকট পড়াশুনার জন্য পাঠিয়ে দিবে এবং তার শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখবে।
( আল বুনইয়ান : ৫ )
স্বপ্ন মুতাবিক ঠিক চল্লিশ দিন পর হযরত রেফায়ী কবীর (রহঃ) জন্মগ্রহণ করেন।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেনঃ رؤيا المؤمن لم تكد تكذب
(খাটি) মুমিনের স্বপ্ন মিথ্যা হয় না।
( মুসলিম শরীফ )
৫. আহমাদ নামকরণ
সন্তানের সুন্দর ও ভাল নামকরণ শরীয়তের নির্দেশ। কারণ, সন্তান নামের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সর্বশ্রেষ্ঠ নাম হচ্ছে মুহাম্মাদ ও আহমাদ। এজন্যেই রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অস্থায়ী পৃথিবীতে মুহাম্মাদ এবং আসমানে ও পরকালে আহমাদ নামকরণ করা হয়েছে। এই দুই নামের পরই শ্রেষ্ঠ নাম হচ্ছে আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান।
হযরত রেফায়ী কবীরের অভাবিত ভবিষ্যৎ উন্নতির এখান থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, স্বপ্নের মাধ্যমে তাঁর নাম আহমাদ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই দূরদর্শী অভিভাবকগণ তার নাম আহমাদই রাখলেন।
এভাবে রাসূলে পাকের হাদীস :
سموا باسمى
“আমার নামে নাম রাখো।”
( বুখারী শরীফ : ১/২১ )
নির্দেশটিরও তাতে প্রতিফলন ঘটে।
(চলবে ইনশাল্লাহ)