মুসলিম জীবনে ‘সময়’-২
লিখেছেন: ' মুসলিম৫৫' @ সোমবার, এপ্রিল ১৯, ২০১০ (১০:৫৮ অপরাহ্ণ)
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
السلام عليكم ورحمة الله و بركاته
[এই সিরিজের প্রথম লেখাটি রয়েছে এখানে: www.peaceinislam.com/muslim55/5793/ ]
আমরা যারা বিশ্বাসী এবং যারা উদ্দেশ্যবাদী (অর্থাৎ যারা মনে করেন য জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে), তারা মনে করি যে, পৃথিবী বা আরো ব্যাপক পরিসরে বলতে গেলে এই গোটা মহা-বিশ্বের সৃষ্টির পিছনে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। বস্তুবাদী অবিশ্বাসীদের কথা অবশ্য আলাদা। এমনিতে তারা প্রতিটি জিনিসের পেছনে কারণ খুঁজে বেড়ান, জীবনের সব কিছুকে ‘কার্যকারণ’ দিয়ে বুঝতে যান। আপনি যদি আপনার ধবধবে শাদা শার্টের উপর দৃশ্যমান একটা লাল দাগ নিয়ে কোন বস্তুবাদী অবিশ্বাসীর সামনে যান – তবে এটা প্রায় অবধারিত যে, সে স্বভাবগত ও মানবসুলভ যুক্তিতে আপনাকে জিজ্ঞেস করবে: “কি হয়েছে?” অর্থাৎ, সে ধরে নিচ্ছে যে, আপনার শাদা শার্টে একটা লাল দাগ এমনি এমনি ফুটে উঠতে পারে না – এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। অথচ মহাবিশ্বের সূচনার বিশাল মহা-জাগতিক ঘটনার বেলায় সে মনে করতে পারে যে, তা এমনি এমনি ঘটেছে কোন কারণ ছাড়া – অথবা মানবদেহের লক্ষ-কোটি কোষের প্রতিটিতে যে চুলচেরা নিয়ম এবং বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়, তা সম্বন্ধে জেনেও সে ভাবতে পারে যে, মানুষের উদ্ভব ঘটেছে কাকতালীয়ভাবে কোন কারণ বা উদ্দেশ্য ছাড়া – বানর জাতীয় প্রাণী থেকে, বিবর্তনের মাধ্যমে। আমার তো মনে হয় বানর শ্রেণীর প্রাণীরা আমাদের সাথে কথা বলতে পারলে, এটুকু জানা যেতো যে, ‘এমনি এমনি মানুষ বা পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে বা তাদের উদ্ভব ঘটেছে’ – এ ব্যাখ্যাটা তাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। এই শ্রেণীর প্রাণীকে আল্লাহ্ যেটুকু বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়েছেন, তার বদৌলতে তারাও হয়তো জেনে থাকবে যে, কোন কিছুই এমনি এমনি অস্তিত্ব লাভ করেনি – সবকিছু সৃষ্টির পিছনে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে।
বৃটিশ বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ফ্রেড হয়েল, এই এমনি এমনি সৃষ্টির ব্যাপারটাকে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন: তার মতে, কোন প্রাণীর এমনি এমনি উদ্ভাবিত হওয়ার চেয়ে বরং কোন ‘জাংক-ইয়ার্ডের’ লোহা-লক্কড় এমনি এমনি যন্ত্রাংশে রূপান্তরিত হয়ে একটা বোয়িং ৭৪৭ এমনি এমনি তৈরী হয়ে উড়ে যাওয়াটা অধিকতর সম্ভাব্য বিষয়।
[দেখুন:page#19, The Intelligent Universe – Fred Hoyle]
তাহলে, যদি এই মহাবিশ্ব বা তার অন্তর্ভুক্ত গ্রহ-তারা-রবি বা আমরা – এই নশ্বর মানবজাতি – এমনি এমনি অস্তিত্ব লাভ না করে থাকি – যদি সত্যিই আমাদের সৃষ্টির পেছনে একটা উদ্দেশ্য থেকে থাকে, তবে সে উদ্দেশ্য কি? পবিত্র কুর’আনে একটি আয়াতে আল্লাহ্ স্পষ্টত ঘোষণা করেছেন এই উদ্দেশ্যের কথা। কুর’আনের আর কোন আয়াতে এমন স্পষ্টভাবে সে উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়নি। সূরা যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন যে, তিনি জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টিই করেছেন কেবলমাত্র তার ইবাদতের জন্য । ইবাদতের অর্থ যে, কেবল নামাজ পড়া বা তসববীহ্ জপা তা নয়। ইবাদতের সাধারণ অর্থ হচ্ছে আদেশ বা নিয়ম মেনে চলা – আল্লাহ্ যে সব নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, সে সব মেনে চলা – নির্ধারিত উপাসনা তো রয়েছেই। আপনি যখন আল্লাহর মত করে, আল্লাহর নির্ধারিত উপায়ে জীবনযাপন করবেন, তখন নিজের স্ত্রীর সাথে হাসি-ঠাট্টায় নিয়োজিত হবার মত নিতান্ত জাগতিক কাজও ইবাদত বলে গণ্য হবে – অবশ্যই, আবারো, সেই হাসি তামাশা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমানার বা কাঠামোর ভিতর হতে হবে – কাফিরদের মত, প্রায় বিবস্ত্র স্ত্রীকে নিয়ে পর পুরুষের উপস্থিতিতে সুইমিং পুলে ঝাঁপা-ঝাঁপি নয় নিশ্চয়ই!
যাহোক, কোন বিশ্বাসী যখন এটা অনুধাবন করবেন যে, তার জীবন, তার জন্ম এবং তার মৃত্যু সবই আল্লাহর এবং সবকিছ্ই আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হওয়া বাঞ্ছনীয় – তখন তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করবেন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চলার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। এমত অবস্থায় আপনার জীবনের আল্লাহ্ অনুমোদিত সকল কাজই ইবাদত বলে গণ্য হবে। আপনিও তখন আল্লাহকে জীবনের প্রতিটি কাজের চালিকাশক্তি বলে অনুভব করবেন। আপনি স্ত্রী-পুত্রের ভরণ-পোষণ করবেন? তাও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে করবেন। আপনি আপনার মুসলিম ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলবেন?? সেও আল্লাহর জন্য করবেন। এভাবে আপনার জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ড যখন আল্লাহ্ অনুমোদিত ও আল্লাহর জন্য বা আল্লাহর কথা ভেবে সমাধা হবে, তখন আপনি উপর্যুক্ত আয়াতের ‘উদ্দেশ্য’ বাস্তবায়িত করবেন। মাননীয় পাঠক! কাফিরদের কথা বলছি না আমি – কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম নামধারীদের দ্বীন নিয়ে না ভাবা, দ্বীনের কাজ না করা, জীবনে দ্বীন ইসলাম প্র্যাকটিস না করা বা দ্বীন সম্বন্ধীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ না করার পিছনে উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত, উহ্য যুক্তিটি প্রায় সবেক্ষেত্রই হচ্ছে: “সময় নেই”। আমি এই ‘সময় নেই’ ব্যাপারটার বাস্তবতা বা সত্যাসত্য নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করেছি। প্রতিটি মানুষের জীবনের প্রতিটি মিনিট তো ৬০ সেকেন্ডেই হয় – এমন নয় যে তা আপেক্ষিক – অর্থাৎ, কারো মিনিট ৩০ সেকেন্ড দিয়ে আবার কারো বা ৯০ সেকেন্ড দিয়ে গঠিত – না তা তো হবার কোন উপায় নেই! অন্তত, যতক্ষণ আমরা সবাই এই পৃথিবীরই বাসিন্দা অর্থাৎ Space-Time-এর একই মাত্রায় অবস্থানরত। তাহলে, এমন কেন হয় যে, জামালুদ্দিন জারাবোযো বা বিলাল ফিলিপ্সরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, দ্বীন সম্মত উপায়ে, সমূহ খুঁটিনাটি সমেত যাপন করার পরও, তাদের হাতে এমন অফুরন্ত সময় থাকে যে, তারা যা বিভিন্ন সভায় মানুষের উদ্দেশ্যে বলে থাকেন বা যা লিখে থাকেন, সেসব খুৎবার রেকর্ডিং শুনে বা সেসব বই পড়েই শেষ করতে পারি না আমরা। সবার জীবনের প্রতিটি মিনিটই যদি ৬০ সেকেন্ডে গঠিত হয়, প্রতিটি ঘন্টা যদি ৬০ মিনিটের সমষ্টি, আর প্রতিটি দিনই যদি ২৪ ঘন্টা দিয়ে গঠিত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী জামাল জারাবযো যদি জীবনের প্রতিটি দিন, দ্বীনের রাস্তায় ব্যয় করতে পারেন, তবে বাংলাদেশের জকিগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী খাদ্য বিভাগের ঘুষখোর কোন কেরানী বা ছাগলনাইয়ায় জন্মগ্রহণকারী টেলিফোনের ঘুষখোর কোন কর্মকর্তা কেন বলেন যে ‘এসব কথা শোনার’ ‘সময়’ তার নেই! এই লাইনে ভাবতে গিয়ে আমি বারবার একটা অবস্থানেই ফিরে গেছি – আমরা, অধিকাংশ মুসলিম নামধারীরা, মূলত উপর্যুক্ত আয়াতের বক্তব্যে বিশ্বাসই করি না – অর্থাৎ আমরা বিশ্বাস করি না যে, ‘আমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে কেবল আল্লাহর ইবাদত করার জন্য’ – তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী চলার জন্য – তাঁকে উপাসনা করার জন্য।
আমাদের জীবনের যে ‘মূষিক-দৌড়’ – যার পরিণতি বা পরিণাম নিয়ে ভাবারও আমাদের ‘সময় নেই’ – একবার আপনি যদি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেকে তার বাইরে নিয়ে গিয়ে ঐ ‘মূষিক-দৌড়’ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন যে, হাস্যকর অনেক লক্ষ্যের জন্য আমাদের তৈরী করা হয়েছে বা ‘সৃষ্টি করা হয়েছে’ – এমনটা মনে-প্রাণে ধারণ করে আমরা প্রাণান্তকর মূষিক-দৌড়ে ব্যস্ত । অথচ, সৃষ্টিকর্তা যে বলছেন, কেবল ‘একটি’ উদ্দেশ্যেই আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে – তার কোন আলামত তো ৯৯% মুসলিমের জীবনে নেইই – এমনকি তারা জানেন কি না বা কখনো শুনেছেন কিনা যে, ঐ ধরনের একটি চূড়ান্ত সংজ্ঞা-জ্ঞাপনকারী আয়াত কুর’আনুল করীমে রয়েছে – আমার সে নিয়েও সন্দেহ আছে!
তবলীগ জামাতের এক কর্মী – আমার এক ছোট ভাই, বছর দুয়েক আগে আমাকে বলছিলেন যে, তারা দেশের একটি গ্রামাঞ্চলে জামাত নিয়ে গিয়ে বুঝতে পারেন যে অনেকে হয়তো ‘কলেমা’ও জানেন না। এমত অবস্থায় কোন তরুণকে আমাদের নবীর নাম জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয় : “শেখ মুজিব”। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য – কোন সস্তা চুটকির বিষয়বস্তু হলে কি স্বস্তির নিঃশ্বাসই না ফেলা যেত! কিন্তু মাননীয় পাঠক, আমি বিশ্বাস করি যে, আমার ঐ ছোট ভাইয়ের মুখ থেকে সত্যি কথাই শুনেছি আমি। আমি তবলীগ জামাতের কর্মী নই, সমর্থকও নই। কিন্তু আমার ঐ ছোট ভাইকে একজন মানুষ হিসেবে আমি যতটুকু জানি – তাতে তথ্যটা নির্ভরযোগ্য। তাহলে বুঝুন ৮৭% মুসলমানের দেশ বলে আমাদের দেশের পরিচয়টা আসলে কেবলি একটা demographic তথ্য – এতে কিছ্ই আসে যায় না – এমনকি এধরনের মুসলমানের সংখ্যা যদি গোটা পৃথিবীর ৮৭%ও হতো তবু এটা নিশ্চিত যে, কুফফার তা নিয়ে বিচলিত হতো না। আমাদের মুসলমানিত্বের আসল গোপন রহস্য – অর্থাৎ, আমাদের মুসলমানিত্বের অন্তঃসারশূন্যতার কথা তারা জানে না। তাহলে তারা আমাদের আলোকপ্রাপ্তি নিয়ে মোটেই বিচলিত হতো না – আমাদের মেয়েদের কষ্ট তথা অর্থনৈতিক কাঠিন্য লাঘব করতে “জন্ম-নিয়ন্ত্রণ” তাদের প্রধান এজেন্ডা হতো না। তারা নিশ্চিন্ত থাকতো এই ভেবে যে, এদের সংখ্যা যতই বাড়ুক না কেন, তা থেকে কুফফারের আশঙ্কার কিছুই নেই। আর (যুক্তরাষ্ট্রের এক কালের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী) Patrick Buchanan লিখতেন না: “For a millennium, the struggle for mankind’s destiny was between Christianity and Islam; in the 21st century, it may be so again…We may find in the coming century that …cultural conservative T.S.Eliot was right, when the old Christian gentleman wrote in ‘The Hollow Man,’ that the West would end, ‘Not with a bang but a whimper’- perhaps the whimper of a Moslem child in its cradle.”
[ দেখুন: “Global Resurgence of Islam”, The Washington Times, 21 August 1989. ]
গ্রামের ঐ তরুণ, নবীর নাম না জানলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইতিমধ্যে পৌঁছে যাওয়া A to Z চ্যানেলের পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছায়াছবির ও নাটকসমূহের বদৌলতে, এরই মধ্যে দেশী ও দেশী ছবিতে অভিনয় করা ভারতীয় রূপ-ব্যবসায়ী নায়িকা ও সহ-নায়িকাদের মাপজোক সম্পর্কে যে সম্যক জ্ঞানলাভ করেছেন, তা একরকম নিশ্চিতই বলা যায়। দেশের যে অংশে আমার বাড়ী, সেখানে কতিপয় চায়ের দোকানে রঙিন টেলিভিশন লাগিয়ে টিকিট দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি তথা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখানো হয়।
আপনি যদি সত্যিই জন-জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে Rat-race বা ‘মূষিক-দৌড়’ পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন, তাহলে বেশ মজার কিছু ব্যাপার দেখতে পারতেন। আপনাকে আমি একটু সাহায্য করছি। প্রায়ই দেখা যায় সাবধানী যাত্রীদের একটা অভিযোগ হচ্ছে এমন যে, আন্তঃজেলা বাসগুলোর ড্রাইভাররা বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালায় – প্রায়ই শুধু শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং-এ আত্মনিয়োগ করে। আপনি যদি দেখেন যে, এই তাড়াহুড়ার বা প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতার পরে তার অর্জন কি বা কতটুকু, তাহলে অবাক হয়ে ভাবতে বসবেন যে, is it worth it?? প্রায়ই দেখবেন যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে আগে পৌঁছে চালক হয়তো আয়েশ করে পায়ের উপর পা তুলে একটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে এক কাপ চা খাচ্ছে। একই কথা রিক্সাচালকদের বেলায়ও প্রযোজ্য।
এবার অধিকতর শিক্ষিত ও ‘সুসভ্য’ নাগরিকদের উদাহরণ দেয়া যাক। একটা কাল্পনিক পরিবারের কথা ধরি। ধরুন স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই কাজ করেন বাইরে। স্বামী কোন বহুজাগতিক কোম্পানির নির্বাহী। কল্পনার সুবিধার জন্য বর্ণনা দিচ্ছি খানিক, ধবধবে শাদা সার্টের উপরে টাই পরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে অফিস করেন – উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চ বেতনভুক্ত। স্ত্রীও চাকুরী করেন কোন প্রাইভেট কোম্পানীতে – ভালো বেতনের চাকুরী। উপরে ওঠার সিঁড়ি যেন তাড়াতাড়ি ডিঙ্গাতে পারেন, সেজন্য বিয়ের ৪ বছর পার হয়ে গেলেও, এখনো সন্তান গ্রহণের কথা বিবেচনা করেননি তারা – অনেকটা বলা যায় এক্ষুণি সন্তান প্রতিপালনের ‘সময় নেই’ তাদের। ধরুন বাসায় কেবল তারা দু’জনেই থাকেন। আর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাসায় ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে, দু’জনের কাছেই ঘরে ঢোকার ভিন্ন দু’টো চাবি আছে। আপনি এখানে পর্যবেক্ষক হিসেবে ধরুন আড়াল থেকে দেখছেন যে, তাদের একজন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ী ফিরছেন – চেহারাটা সিরিয়াস। তিনি ঘরের দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে ঢুকে ঘর আলোকিত করতে লাইট জ্বালালেন। এবার বলুন তো তিনি প্রথমেই কোন কাজটি করবেন?
একটু আগে আপনাদের বলেছি যে, আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিক সভ্যতার ব্যাপ্তির ফলে আমাদের সময়ের বিশাল সাশ্রয় হবার কথা – আর সেই সময় দিয়ে আমাদের কি করার কথা? আমরা যদি বিশ্বাস করি যে, আমাদের জন্মই হয়েছে কেবল আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, তাহলে তো সাশ্রয় থেকে পাওয়া বাড়তি সময়টুকুতে আল্লাহর ইবাদত করার কথা; আল্লাহ্ যে সব কাজে খুশী হবেন, সেসবে সেই সময় ব্যয় করার কথা। উপরের প্যারাগ্রাফের নাগরিক স্বামী বা স্ত্রী ঘরে ঢুকে প্রথমেই কি কাজটি করবেন আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – আমিই বলে দিচ্ছি। প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, তারা প্রথমেই তাদের TVটি চালু করবেন – নাগারিক জীবনে যাদের স্যাটেলাইট সংযোগ রয়েছে (আমার মত দু’একজন সেকেলে মানুষ ছাড়া যা আজকাল প্রায় সবারই রয়েছে) তাদের বেলায় আমার ‘TV চালু করার তত্ত্ব’ আরো নিশ্চিত ভাবে সত্যতা লাভ করবে ইনশাল্লাহ্ ! শুধু তাই নয়, এই TV যতক্ষণ তারা জেগে থাকবেন, ততক্ষণই যে চলতে থাকবে, তাও একপ্রকার নিশ্চিত। তাহলে ব্যাপারটাকে সহজে বলতে চাইলে কি এভাবে বলা যায় না যে, আমরা জীবনে যে সময়ের সাশ্রয় করছি তার একটা কারণ হচ্ছে আমরা যেন TV দেখতে পারি ঐ বেঁচে যাওয়া সময়ে, অথবা, আমরা যেন আয়েশ করে সিগারেট ফুঁকতে পারি। এভাবে আপনি অনুসন্ধান করলে দেখবেন যে, মানুষ একজোড়া মোজা কিনতে তিন ঘন্টা নিউ মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে – কেউবা জায়ের মামাতো বোনের মেয়ের বিয়েতে তাকে যেন দেখতে ভালো দেখায়, সেজন্য ৬ ঘন্টা কোন বিউটি পার্লারে কাটাচ্ছে। অথচ আত্মীয়, বন্ধু বা সুহৃদের সাথে কথা বলার সময় নেই তাদের – দ্বীনের কথা শোনার বা ভাবার কথা বাদই দিলাম।
আমি যে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তাম সেটা ইসলামপন্থীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মসজিদ। আমার বাসা থেকে মাইল দু’এক দূরে হলেও আমি সেখানে যেতাম মূলত দু’টো কারণে: ওখানকার খতীবরা সব দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত বিধায় তাদের খুৎবা সারবান হয়। আর দ্বিতীয়ত, অনেক বিদ’আত থেকে মুক্ত থাকা যায় ওখানকার পরিবেশে। এক জুম্মায় হঠাৎ খেয়াল করলাম যে, মসজিদে মাত্র দেড় সারি মানুষের সমাগম হয়েছে – যে সময় গিয়ে আমাকে সাধারণত ৭ম সারিতে বা তারো পিছনে স্থান করে নিতে হতো। আমার প্রথম চিন্তা ছিল কোথাও কোন অঘটন ঘটেনি তো? পরে বুঝলাম আসলে বহুদিন বন্ধ থাকার পর পাকিস্তান ও ভারতের ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে পাকিস্তানে – ইয়াওমাল জুম্মায় ঐ ম্যাচ পড়াতে, তা মুসল্লিদের কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে বুঝিবা – তাই তারা কষ্ট করে এই মসজিদে না এসে হয়তো কাছের কোন মসজিদে নামাজ সেরে নিয়েছেন – যাতে ইরফান পাঠানের ব্যাটিং দেখা থেকে যথাসম্ভব কম বঞ্চিত হন তারা।
ইরফান পাঠানের কথা ইচ্ছা করেই বল্লাম এজন্যে যে, হিন্দুস্থানের পক্ষে অংশ গ্রহণ করা এই মুসলিমকে নিয়ে গর্বভরে নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশের একটি ইসলামপন্থী পত্রিকা। সেখানে বলা হয়ের্ছিল যে ইরফান পাঠানের ক্রিকেট খেলার প্রেরণার উৎস হচ্ছেন আল্লাহ্ (as if ক্রিকেট খেলা প্রায় যুদ্ধ-জয়ের মতই একটা গৌরবময় কর্মকাণ্ড)। তার পরেই আসছিল ইরফান পাঠানের ব্যক্তিগত জীবনের কথা। তার স্বপ্নকন্যা নাকি হিন্দুস্থানী ফিল্মী নায়িকা জুহী চাওলা – ইরফান পাঠান জুহী চাওলাকে জীবন সঙ্গিনী করতে না পারলেও, এমন কাউকে জীবন সঙ্গিনী করতে চান, যার মাঝে তিনি জুহী চাওলাকে খুঁজে পাবেন। মাননীয় পাঠক! এব্যাপারটি নিয়ে সুন্দর করে কথা বলার ভাষাও আমি হারিয়ে ফেলেছি। ক্রিকেট খেলার মত একটা খেলা – যা মানুষকে সারাদিন স্টেডিয়ামে বা TV সেটের সামনে আটকে রাখে – এমন কি জুম্মার নামাজে মসজিদে আসা থেকে পিছু টেনে ধরতে প্রয়াস পায় – সারা দেশের মানুষের সময়ের এই বিশাল অপচয়কে ও আসক্তিকে, ইসলামপন্থীরা যদি ইসলাম বিরুদ্ধ ব্যাপার বলে সনাক্ত না করে বরং প্রশংসনীয় মনে করেন এবং জুহী চাওলার ‘ক্রীতদাস’ ইরফান পাঠানের মুসলিম পরিচয়ে গর্ববোধ করে নিবন্ধ ছাপাতে পারেন, তবে ধিক্ তাদের ইসলামপন্থী পরিচয়ে আর ইকামতে দ্বীনের বুলিতে। তারাও হয়তো ঐ আয়াতের কথা শোনেননি যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘মানুষ এবং জ্বীনকে সৃষ্টিই করা হয়েছে কেবল আল্লাহ্র ইবাদত করার জন্য’। অথবা, শুনলেও হয়তো ‘ইসলামপন্থী’ থেকে হালে ‘তিজারাহ্পন্থী’ হতে গিয়ে, তারা আজ তা ভুলতে বসেছেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার মানুষেরা আমাদের পিতামহদের যুগের তুলনায় এক জীবনে যে বাড়তি প্রায় সাড়ে নয় বছর সময় লাভ করছেন (৫৭ বছরের গড় আয়ু ধরে নিয়ে এবং নানাবিধ যান্ত্রিক উন্নতিবলে প্রতিদিন ৪ ঘন্টা সময় বেঁচে যাচ্ছে বলে ধরে নিলে মোট সাশ্রয় হচ্ছে ৫৭x৩৬৫x৪ = ৮৩২২০ ঘন্টা = ৯.৫ বছর) তা মূলত ব্যয় হয়:
১) মূষিক দৌড়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে
২) TV দেখতে
৩) অন্যান্য বিনোদনে
বা
৪) অশ্লীল ও শরীয়ত বিরূদ্ধ কাজে।
অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়: ‘আমাদের জীবনের ধরন এবং জীবনযাত্রা থেকে এমনটা মনে হবার কথা যে আমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে কেবল অর্থ-উপার্জনের জন্য বা TV দেখার জন্য বা বিনোদনে গা ভাসানোর জন্য অথবা ভোগ-সুখে আত্মনিয়োগ করার জন্য।’
(চলবে ……..ইনশা’আল্লাহ্!)
আলহামদুলিল্লাহ। ভালো লিখেছেন।
কোন বিষয়ে দ্বিমত নেই।
@দ্য মুসলিম, ধন্যবাদ ভাই, ভালো থাকুন!
আসসলামু আলাইকুম ভাই, কেমন আছেন?
আপনার আগের লেখাটিও পড়েছিলাম অপেক্ষায় ছিলাম দ্বিতীয়টির জন্যে মাশাল্লাহ, চমৎকার লিখেছেন। আল্লাহ তাআলা আপনার লেখার শক্তি আরো বাড়িয়ে দিক। আমীন।
@manwithamission, ওয়া আলাইকাস সালাম! আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ্ খুব ভালো রেখেছেন!!
আমাকে চমৎকার একটা দোয়া করার জন্য ধন্যবাদ। JazakAllahu Khair!